সারফুদ্দিন আহমেদঃ
সবুজবাগের সবুজ কানন মহল্লার বিখ্যাত একটি টি স্টলের নাম ‘খলিল মিয়ার চায়ের দোকান’। মালিকের নাম খলিল মিয়া। রোজ ভোরে ও রাতে এ দোকানের সামনের রাস্তায় শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে থাকে ‘কয়েকজন’ পথকুকুর। তারা মুজতবা আলীর গল্পের পণ্ডিত মশাইয়ের সারা মাসের মাইনের তিন গুণ টাকায় পালিত লাট সায়েবের তিন ঠ্যাংয়ের বিলাতি কুকুর না। তারা মায়ে তাড়ানো, বাপে খেদানো কুকুর। অলিতে-গলিতে ঘোরে। এই ডাস্টবিন, সেই নর্দমা থেকে খাবার খেয়ে পেট চালায়।
খলিলের দোকানের সামনে কুকুরগুলোর জড়ো হওয়ার কারণ, এখানে আসা কয়েকজন চা-খোর তাদের রুটি বা কেক কিনে খেতে দেন। সেই খাবারের টানে তারা আসে।
এক ভদ্রলোক আছেন, যিনি দুই তিন মাসের জন্য বিদেশে গেলে খলিল মিয়াকে আগাম টাকা দিয়ে যান, যাতে তিনি কুকুরগুলোকে রুটি-বিস্কুট দেওয়া বন্ধ না করেন। বেওয়ারিশ কুকুরের এমন অভিভাবকের সংখ্যা ঢাকা শহরে কম নয়। অনেকেরই ‘আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর/আছে এক লেজ-কাটা ভক্ত কুকুর’।
কয়েক দিন আগে এক ভদ্রলোক বলছিলেন, তাঁর তিনটি কুকুর ‘গুম’ হয়ে গেছে। আশ্চর্য কথা! কুকুর তো ‘অমুক নেতা’ বা ‘তমুক সন্ত্রাসী’ না যে গুম হবে! কিন্তু তাঁর কথায় মনে হলো ঘটনা সত্য। তিনি বলছিলেন, তিনি পাঁচটি কুকুরকে রোজ খেতে দিতেন। সপ্তাহখানেক ধরে তাদের মধ্য থেকে তাঁর ‘টাইগার’ ও ‘বাহুবলী’ খেতে আসছে না, দেখছেন না আরেকটিকেও। তাঁর ধারণা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লোকজন ওই ‘তিনজনকে’ ধরে নিয়ে গেছেন। এতে তাঁর মন খারাপ।
আবার কয়েকজনকে কুকুর ‘গুমের’ খবরে ভারি খুশি হতে দেখা গেল। একজন বললেন, ‘বউ–পোলাপান কুত্তার জ্বালায় রাস্তায় নামবার পারে না। অ্যাদ্দিন পর ডিএসসিসি একটা কামের কাম করল।’
ঢাকাবাসীর দুই পক্ষে ভাগ হওয়ার বাতিক নতুন নয়। ইস্যু একটা পেলেই তারা কমপক্ষে দুই পক্ষে ভাগ হয়। একপক্ষ ‘মানি না’ বলে চিল্লায়। অন্যপক্ষ ‘মানতে হবে’ বলে শাসায়। আপাতত কুকুর মারা (‘সারমেয়নিধন’ টাইপের সাহিত্য ছোঁয়ানো শব্দবন্ধে কুকুরের মৃত্যুযন্ত্রণা কমবে না বলে সোজা বাংলায় ‘কুকুর মারা’ বললাম) নিয়ে তারা দুই ভাগ হয়েছে। ফেসবুকে ভার্চ্যুয়ালি ও রাজপথে গায়ে-গতরে দুই পক্ষই দাঁড়িয়ে গেছে। একপক্ষ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কুকুর ‘অপসারণের’ পক্ষে। আরেক পক্ষ বিপক্ষে। তাঁরা পশুপ্রেমী। কুকুরের পক্ষে দাঁড়ানোয় তাঁদের ‘কুকুরের জন্য এত চিন্তা, কই গরিবের জন্য তো কিছু করেন না?’ টাইপের কথাও শুনতে হচ্ছে।
ফেসবুকে ভেসে বেড়ানো ছোট ছোট ভিডিও ক্লিপে লোকজনকে নানা কায়দায় ঢাকার রাস্তা থেকে কুকুর ধরতে দেখা যাচ্ছে। মরা কুকুরবোঝাই মিনি ট্রাকের ছবিও দেখা যাচ্ছে। ডিএসসিসি বলছে, এসব ছবি ও ভিডিওচিত্রের বেশির ভাগই পুরোনো। তারা বলছে, তারা হাজার তিরিশেক কুকুর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকা থেকে ‘অপসারণ’ করবে। এই ‘অপসারণ’ মানে স্থানান্তর নাকি ‘চির বিদায়’ সেটি অবশ্য খুব স্পষ্ট নয়।
ডিএসসিসি বলেছে, এরই মধ্যে কয়েক শ কুকুর তারা মাতুয়াইলে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু সংখ্যাটা যেহেতু ৩০ হাজার, সেহেতু এত কুকুর কোথায় রেখে আসা হবে, সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। পাবলিকের ধারণা, এক জায়গা থেকে কুকুর ধরে আরেক জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসার মতো হ্যাপা ডিএসসিসি পোহাবে না। তার চেয়ে তাদের ‘নাই’ করে দেওয়া সোজা। সেই কাজই তারা হয়তো করবে।
কুকুরনিধন রোধে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। রিটের পর নতুন আইন পাশ হয়েছে। সেখানে ৭ নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘নিধন বা অপসারণ করা যাবে না।’ তার মানে ডিএসসিসি যদি কুকুরগুলো না মেরে অপসারণও করে, তাতেও আইন ভাঙা হবে। তারা বোঝাতে চাচ্ছে, কিচ্ছু করার নেই, আইন না ভেঙে উপায় নেই, ‘নেসিসিটি নোওজ নো ল’। আইন ভাঙার অজুহাত হিসেবে ‘ডকট্রিন অব নেসিসিটি’ শব্দবন্ধটি বিগত জরুরি অবস্থার সময় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ডিএসসিসি সেই লাইন ধরেছে বলে মনে হচ্ছে।
তবে সেই লাইনে হাঁটছে না উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তারা কুকুর নিধন বা অপসারণ না করে লাইগেশনের পথে হাঁটছে। বন্ধ্যাকরণের জন্য ‘অভয়ারণ্য’ নামে একটি এনজিওর সঙ্গে আগেই তাদের চুক্তি ছিল। সে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এখন চুক্তি নবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ঢাকার দুই সিটির সীমানায় যেহেতু কোনো বেড়া বা দেয়াল নেই, সেহেতু জান বাঁচাতে দক্ষিণের কুকুর আপাতত উত্তরে গিয়ে ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ চাইতে পারে। কিন্তু মানুষের আইনের মারপ্যাঁচ বোঝার মতো আক্কেল নেই বলে সেই অভিবাসন সে নিতে পারছে না। তাই গুম হওয়া ছাড়া তাদের আপাতত উপায় নেই।